বিদ্রোহী কবিতার অনুধাবন প্রশ্ন ও উত্তর পোস্টে আপনাকে স্বাগতম। বিদ্রোহী কবিতার অনুধাবন প্রশ্ন ও উত্তর খুজতেছেন? আজকের আর্টিকেলটি আপনাদের জন্য। আজকের আর্টিকেলে বিদ্রোহী কবিতার অনুধাবন প্রশ্ন ও উত্তর শেয়ার করা হবে। তাহলে চলুন শুরু করা যাক।
বিদ্রোহী কবিতার অনুধাবন প্রশ্ন ও উত্তর
১. ‘যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না’ – একথা বলার কারণ কী?
উত্তর : নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের দুঃখকষ্ট ও আর্তচিৎকার বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত কবি বিপ্লব-প্রতিবাদ চালিয়ে যাবেন বোঝাতে তিনি প্রশ্নোক্ত কথা বলেছেন। অসাম্য ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে কবির বিদ্রোহ নিরন্তর। যেখানেই তিনি অত্যাচার ও অনাচার দেখেছেন, সেখানেই বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন।
নিপীড়কের বিরুদ্ধে এবং আর্তমানবতার পক্ষে প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছেন তিনি। তাঁর হুংকারে কেঁপে উঠেছে অত্যাচারীর ক্ষমতার মসনদ। অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলেও উৎপীড়িত মানুষের পক্ষে বিপ্লব-প্রতিবাদ অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তিনি। এ বিষয়টিকে স্পষ্ট করতেই তিনি প্রশ্নোক্ত চরণটির অবতারণা করেছেন।
২. ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য’- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : প্রেম ও দ্রোহের সমন্বয়ে নিজ অস্তিত্বের স্বরূপ তুলে ধরতেই কবি প্রশ্নোত্ত চরণটির অবতারণা করেছেন। কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি।
মানবপ্রেম ও সাম্যচেতনা তাঁর কবিতার মূল প্রেরণা। আর তাই যেখানেই অসাম্য ও অনাচার লক্ষ করেছেন, ব্যথিত কবি সেখানেই উচ্চারণ করেছেন দ্রোহের পক্তিমালা। আলোচ্য কবিতাটিতেও কবির দ্রোহ পরাধীনতার শৃঙ্খল এবং অসাম্যের বিরুদ্ধে, যার মুখ্য উদ্দেশ্য মানবমুক্তি।
নিপীড়িত মানুষের ক্রন্দন বন্ধ করার প্রয়াসেই তাঁর এই দ্রোহ। কবি সত্তার এই বিদ্রোহী রূপ এবং তার অন্তরালে মানবপ্রেমের বিষয়টি বোঝাতেই কবি প্রশ্নোত্ত চরণটির অবতারণা করেছেন।
৩. ‘আমি দুর্বার/ আমি ভেঙে করি সব চুরমার’ – ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : আলোচ্য উত্তিতে কবির বিধ্বংসী রূপের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কবি শোষণ-বঞ্চনা ও অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ। পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বেনিয়া শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দোসরদের অপশাসন ও ভেদ-বৈষম্যের জাঁতাকলে পিষ্ট দেশবাসীকে তিনি মুক্ত করতে চান।
এ লক্ষ্যেই দুর্বার গতিতে তিনি শোষক ও অত্যাচারীর সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে চান। প্রশ্নোক্ত চরণটিতে বিদ্রোহী কবিসত্তার এমন বিধ্বংসী রূপই প্রতিফলিত হয়েছে।
৪. কবি নিজেকে ‘অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল’ বলেছেন কেন?
উত্তর : নিয়ম-শৃঙ্খলার বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব নয় বলে কবি নিজেকে ‘অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল’ অভিহিত করে শৃঙ্খল ভাঙার বার্তা দিয়েছেন।
পরাধীন ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের জাঁতাকলে মানুষকে নিষ্পেষিত হতে দেখে কবির হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে।
তিনি দেখেছেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলেই আইন ও বাধ্যবাধকতার বেড়াজালে মানুষকে নাকাল হতে হয়। সংগত কারণেই তিনি আইনের এই বেড়াজাল ভেঙে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন।
শুধু তাই নয়, এ লক্ষ্য সামনে রেখেই তিনি অনিয়ম দিয়ে প্রচলিত নিয়মকে এবং উচ্ছৃঙ্খলতা দিয়ে শৃঙ্খলিত ও প্রথাবদ্ধ জীবনব্যবস্থাকে ভাঙতে চেয়েছেন। এজন্যই কবি নিজেকে ‘অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল’ বলে অভিহিত করেছেন।
৫. ‘আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সূত বিশ্ব-বিধাতৃর’- ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : অন্যায় ও অসাম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী চেতনার ধারক হিসেবে কবি নিজেকে বিশ্ববিধাতার বিদ্রোহী পুত্র বা সুত বলে অভিহিত করেছেন।
পরাধীন ভারতবর্ষে তখন আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে সমাজে শক্ত আসন গেড়েছে অন্যায়-অত্যাচার ও বৈষম্য। সরে কারণেই সমাজে জেঁকে বসা এই বৈষম্য ও অচলায়তনকে ভাঙতে চেয়েছিলেন কবি। এ লক্ষ্যেই তিনি উচ্চারণ করেন দ্রোহের পরিমাণ।
তাঁর এই দ্রোহ কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে তিনি বিধ্বংসী রূপ নিয়ে আবির্ভূত হন। বিদ্রোহী চেতনার ধার হিসেবে অন্যায় ও অসাম্যের বিরুদ্ধে তাঁর এই নিরন্তর দ্রোহের বিষয়টি বোঝাতেই কবি নিজেকে বিশ্ব-বিধাতার বিদ্রোহী-সুত বা ধীর পর বলে অভিহিত করেছেন।
৬. কবি নিজেকে ‘অর্ফিয়াসের বাঁশরী’ বলেছেন কেন?
উত্তর : বাঙালি জাতিকে বিদ্রোহের অগ্নিমন্ত্রে জাগ্রত করার মানসে কবি গ্রিক পুরাণে উল্লিখিত মহান শিল্পী অর্ফিয়াসের বাঁশির সাথে নিজের তুলনা করেছেন। অর্ফিয়াস গ্রিক পুরাণের একজন মহান কবি ও শিল্পী। তিনি যন্ত্রসংগীতে সকলকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন।
শুধু তাই নয়, সুরের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে তিনি ভালোবাসার পাত্রী ইউরিডিসের মন জয় করেছিলেন। কবির প্রত্যাশা, অর্ফিয়াসের বাঁশির সুরের মতো তাঁর বিদ্রোহের সুরও মানুষের মাঝে ছড়িয়ে যাবে। সে সুরে বিদ্রোহের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হবে দেশবাসী। মিলবে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি। এমন ভাবনা থেকেই কবি নিজেকে অর্ফিয়াসের বাঁশি বলে অভিহিত করেছেন
৭. ‘আমি চেঙ্গিস’ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তর : কবি নিজের মাঝে বিধ্বংসী যোদ্ধা চেঙ্গিস খানকে কল্পনা করে নিজের বিদ্রোহ ও সংগ্রামকে নতুন মাত্রা দিতে প্রয়াসী হয়েছেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কবি নানা বিধ্বংসী চরিত্রকে অবলম্বন করে তাঁর দ্রোহের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন।
এক্ষেত্রে কখনো পুরাণ আবার কখনো ঐতিহাসিক অনুষঙ্গে ভর করে কবি তাঁর ধ্বংসকামী সত্তার পরিচয় জ্ঞাপন করেছেন। এরই অংশ হিসেবে কবি নিজেকে দূর্র্ধষ মোঙ্গল যোদ্ধা ও সেনাপতি চেঙ্গিস খানরূপে কল্পনা করেছেন। চেঙ্গিস খান অত্যন্ত নৃশংস ছিলেন। আলোচ্য কবিতায় কবি নিজেকে চেঙ্গিস খান রূপে কল্পনা করে মূলত অপশক্তিকে ধ্বংসের বার্তা দিতে চেয়েছেন।
৮. কবি নিজেকে ‘মহা-প্রলয়ের নটরাজ’ বলেছেন কেন?
উত্তর : নটরাজ শিবের মতো ধ্বংসলীলা চালিয়ে অপশক্তি নাশ করে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই করি নিজেকে মহা-প্রলয়ের নটরাজ বলেছেন। ভারতীয় পুরাণ মতে, নৃত্যকলার উদ্ভাবক হিসেবে মহাদেব শিবের আর এক নাম নটরাজ।
তাঁর ধ্বংসের সময়কার নৃত্যকে তাণ্ডব নৃত্য বলা হয়। গজাসুর ও কালাসুরকে নিধন করে তিনি তাণ্ডব নৃত্য করেছিলেন। কবিও পুরাণের সে ঐতিহ্য স্মরণ করে সমকালীন প্রেক্ষাপটে অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীসহ সকল প্রকার অপশক্তিকে ধ্বংস করতে চেয়েছেন। তারই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে নিজেকে তিনি মহা-প্রলয়ের নটরাজ বলে অভিহিত করেছেন।
৯. “শির নেহারি’ আমারি, নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির” ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : “শির নেহারি’ আমারি, নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির’’ – কথাটির মধ্য দিয়ে আত্মজাগরণে উন্মুখ কবির সদম্ভ আত্মপ্রকাশ ঘোষিত হয়েছে।
আলোচ্য কবিতার কবি বীর ধর্মের অনুসারী। আত্মপ্রত্যয়ী বীরের চিত্র সর্বদাই সমুন্নত। সংগত কারণেই কবির এই বীর সত্ত্বা কোনোকিছুকে পরোয়া করে নাঃ ধ্বংসের দামামা বাজিয়ে এগিয়ে যায় নতুন সৃষ্টির লক্ষ্যে।
কবি মনে করেন, আত্মগৌরবে বলীয়ান তাঁর সেই সসম্ভ বিরোচিত রূপ অবলোকন করে হিমাদ্রি তথা হিমালয়ও যেন মাথা নত করে। প্রশ্নোত্ত চরণটির মধ্য দিয়ে এ বিষয়টিই ফুটে উঠেছে।
১০. কবি নিজেকে পৃথিবীর অভিশাপ বলেছেন কেন?
উত্তর : সমাজে বিরাজমান অন্যায় ও অসাম্যের বিরুদ্ধে তাঁর বিধ্বংসী রূপ বোঝাতেই কবি নিজেকে পৃথিবীর অভিশাপ বলে উল্লেখ করেছেন। পরাধীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজশক্তি তখন জগদ্দল পাথরের মতো এদেশবাসীর ওপর চেপে বসেছে। অত্যাচারী এই শাসকগোষ্ঠীর অপশাসনে সমগ্র দেশই যেন নরকে রূপান্তরিত হয়েছে।
এদের ধ্বংস করতে হলে এক ভয়ানক রুদ্রের প্রয়োজন, যে এদের সাজানো বাগানকে তছনছ করে দিতে পারে। কবি নিজেই সেই রুদ্ররূপ ধারণ করে অত্যাচারীর জন্য মহাপ্রলয় আনতে চেয়েছেন। তিনি যেন সাক্ষাৎ অভিশাপ, যিনি অত্যাচারী ও শোষকের সাম্রাজ্যকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করবেন। এমন মনোভাব থেকেই নিজেকে তিনি পৃথিবীর অভিশাপ বলেছেন।
সাম্যবাদী কবিতার অনুধাবন প্রশ্ন ও উত্তর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি সবাই বুঝতে পেরেছেন। কেউ কিছু বুঝতে না পারলে কমেন্ট বক্সে জানাবেন। ধন্যবাদ সবাইকে।